Tuesday, November 27, 2018

বিএনপিতে প্রার্থীর ঢল

বিএনপিতে প্রার্থীর ঢল

  • ৮০০ জনকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে বিএনপি
  • অধিকাংশ আসনে দুজন, কোথাও তিনজনকে চিঠি
  • প্রায় প্রতি আসনেই বিকল্প প্রার্থী বিএনপির
  • তালিকার প্রথম নাম মূল প্রার্থী বিবেচিত হবেন
  • চূড়ান্ত হওয়ার পর বাকিরা প্রত্যাহার করে নেবেন
  • মনোনয়নপত্রের চিঠি বিতরণে বিশৃঙ্খলা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের একরকম ঢল নেমেছে বিএনপিতে। ৩০০ আসনেই বিএনপি প্রায় ৮০০ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কিছু আসন বাদ দিলে প্রায় সব আসনেই দুজন, অনেক জায়গায় তিনজনকেও মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে অনেকে বিব্রত হচ্ছেন। এর ফলে মাঠপর্যায়ে নেতায় নেতায় বিরাজমান দ্বন্দ্ব আরও জোরালো হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কাও করছেন।
অবশ্য দলীয় সূত্র বলছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগে জোটের শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা হবে। তত দিনে দলেরও প্রতি আসনে একক প্রার্থীও চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তখন বাকিরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন।
গত সোমবার থেকে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া শুরু হয়। গতকাল ​মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মনোনীতদের চিঠি দেওয়া হয়। আসন​ভিত্তিক কোনো তালিকা বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।
গতকাল বিকেলে গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আমাদের দল থেকে এখনো পর্যন্ত মনোনয়ন দিয়েছি ৮০০-র মতো। ২০-দলীয় জোটের শরিকদেরও দেওয়া হয়েছে। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের নিজ নিজ দল থেকে মনোনয়ন দিচ্ছে। পরে যখন বাছাই হয়ে যাবে, তখন ঠিক করা হবে।’
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, কৌশলগত কারণে নীতিনির্ধারকেরা প্রায় সব আসনে একাধিক প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়নের চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সীমিতসংখ্যক আসনে বিকল্প প্রার্থী রাখার কৌশল নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১০টি আসনে আওয়ামী লীগ দুজন করে প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু গত দুদিনে বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় দেখা যায়, দলের প্রবীণ-নবীন ও সংস্কারপন্থী—সব পক্ষকেই ধরে রাখার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এতে করে মূল প্রার্থীর পাশাপাশি বিকল্প প্রার্থীদের রীতিমতো ঢল নেমেছে।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের ধরে রাখার কৌশল থেকে কিছু আসনে একাধিক প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, সরকারি মহল থেকে দীর্ঘদিন থেকে দল ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে। এখন নির্বাচনের সময় বিভিন্ন আসনে নেতা ভাগানোর চেষ্টা হতে পারে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু এ কৌশল এখন গড়পড়তা হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকায় নাম ঢোকাতে অনেকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে তদবির করছেন। এতে অনেকে সফলও হয়েছেন। আবার তালিকায় নাম ঢোকাতে টাকাপয়সার লেনদেন হচ্ছে বলেও গুঞ্জন আছে।
প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় দেখা যায়, সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত অধিকাংশ নেতা মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন, যাঁদের সম্প্রতি দলে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে তাঁদের সবার সঙ্গে এক বা একাধিক বিকল্প প্রার্থী রাখা হয়েছে। যেমন বরিশাল-১ আসনে সংস্কারপন্থী নেতা জহিরউদ্দিন স্বপনের সঙ্গে আবদুস সোবহান, রাজশাহী-৪ আসনে আবু হেনার সঙ্গে আবদুল গফুরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর বরিশাল-২ আসনে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, নির্বাহী পরিষদের সদস্য শরফুদ্দীন আহমেদ সান্টু ও শহিদুল হক জামাল। শহিদুল হক সংস্কারপন্থীদের মধ্যে অন্যতম।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, তারা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, ঋণ ও বিলখেলাপিসহ নানা কারণে দলের অন্তত অর্ধশত সম্ভাব্য প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। এ ব্যাপারে সরকারি মহল তৎ​পর। তাই প্রথমে অর্ধশত আসনে বিকল্প প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে প্রায় সব আসনেই একাধিক প্রার্থী রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মূল প্রার্থী হচ্ছেন তালিকার যিনি প্রথম। তিনি কোনো কারণে বাদ পড়লে দ্বিতীয়, তিনি না করতে পারলে তৃতীয়জন মনোনীত প্রার্থী হবেন। সেভাবেই সিরিয়াল করা হয়েছে।’
মওদুদ আহমদ নিজেও নোয়াখালী-৫ আসনে স্ত্রী হাসনা মওদুদকে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘তার মানে এ​ই নয় যে আমি দাঁড়াচ্ছি না। আমি নিজে থেকেই তাঁকে বিকল্প প্রার্থী করেছি।’
 চিঠি বিতরণে বিশৃঙ্খলা
দলীয় মনোনয়নের চিঠি দিতে গিয়ে একরকম জট পাকিয়ে ফেলেছে বিএনপি। চিঠি বিতরণে কোনো ব্যবস্থাপনা দেখা যায়নি, বিশৃঙ্খলা ছিল সর্বত্র। আসন ধরে কখন কাকে বা কতজনকে চিঠি দেওয়া হবে—তার কোনো পরিকল্পনা আগে থেকে করা হয়নি। ফলে এক আসনে একজনকে চিঠি দেওয়ার এক দিন পর আরেকজনকে ডেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেমন ভোলা-৩ আসনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দেওয়ার দুদিন পর সেই আসনে চিঠি দেওয়া হয় কামাল হোসেনকে। তিনি পেশায় আইনজীবী, তবে এলাকায় তেমন পরিচিত নন।
জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়ার আগেই স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেককে দলীয় প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। শুরুর দিন গুলশানের কার্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে চিঠি দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও এই কার্যক্রম শুরু হয় বিকেল চারটায়। এ অবস্থায় ডাক পেয়ে কার্যালয়ে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০-দলীয় জোটের একটি শরিক দলের মহাসচিব প্রথম আলোকে বলেন, মনোনয়নের বিষয়ে কথা বলতে তাঁকে গত সোমবার দুপুর ১২টায় গুলশান কার্যালয়ে আসতে বলা হয়। কিন্তু বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বিএনপির ওই দায়িত্বশীল নেতার সাক্ষাৎ পাননি। অবশেষে মঙ্গলবার বেলা দুইটায় তাঁর দলের চেয়ারম্যানের মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয়।
চিঠি দেওয়ার প্রথম দিন গত সোমবার গুলশানের কার্যালয়ে মাইক লাগিয়ে সংসদীয় আসন ও প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে চিঠি নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার মাইকে ঘোষণা দেওয়া বন্ধ ছিল। ফলে কোন আসনে কাকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়, তা বের করতে গণমাধ্যমকর্মীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। গতকালও কয়েক ঘণ্টা দেরিতে দুপুর ১২টার পর চিঠি দেওয়া শুরু হয়। এই কার্যক্রম চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
মনোনয়নের চিঠি বিলিকে কেন্দ্র করে গত দুদিন গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিএনপির হাজার হাজার নেতা–কর্মীর ভিড় ছিল। দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশের কেন্দ্রে নিরাপত্তাকর্মীরা খুব কড়াকড়ি আরোপ করেন। গতকাল মনোনয়নের জন্য ডাক পাওয়া কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ করেন, পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। পরে নিরাপত্তাকর্মীদের বকশিশ দিয়ে ভেতরে ​প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন।
 এখনো জোটের আসন চূড়ান্ত হয়নি
গতকাল পর্যন্ত ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে এমন শরিক দলগুলোকে যার যার মতো করে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে। গতকালই অনেকে এলাকায় চলে গেছেন। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২০ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ২৫টি আসনে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) চারটি আসনে, বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে একটি করে আসন নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ১০ বছর পর নির্বাচনে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে নির্যাতন-সংগ্রামে বহুসংখ্যক নেতা ও প্রার্থী তৈরি হয়েছে। এ কারণে এক আসনে দুজন-তিনজন করে প্রার্থী হয়েছেন। তবে মনোনয়ন বোর্ডে সবাই অঙ্গীকার করেছেন যে যিনি চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পাবেন, সবাই তাঁর জন্য কাজ করবেন। এরপরও ওয়াদা ভঙ্গের আশঙ্কা যে নেই, তা নয়।

No comments:

Post a Comment