জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে বেশ খুশি অর্থমন্ত্রী ওলাফ শলত্স। চলতি সপ্তাহে দেশবাসীকে তিনি সুখবরই দিয়েছেন। সরকারি ঋণের পরিমাণ এখন জিডিপির ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ইউরোজোনের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যেই রয়েছে। ওলাফ শলত্স বলেন, ‘সত্যিই এটি অনেক বড় সাফল্য, সত্যিকারের জয়।’
সম্প্রতি ২০১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করে এই খবর দেন ওলাফ। বাজেট এবারও ঘাটতি পূরণে কোনো নিট ঋণ নিতে হচ্ছে না জার্মানিকে। এই নিয়ে টানা ছয় বছর ঋণে ‘ব্ল্যাক জিরো’ প্রেফারেন্স জার্মানির। শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে যেকোনো অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত তারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সরকার আশা করছে, চলতি বছরে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং আগামী বছর হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জনগণের ভোগ ব্যয়, আমদানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে।
তরকারির নুন-ঝাল সব ঠিক থাকলেও ঝোল কিছুটা কমই আছে। ভাতটা শুকনোই শুকনোই খেতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে চমৎকার অবস্থা খারাপ হতে খুব বেশি সময় নাও লাগতে পারে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে জার্মান অর্থনীতি নিয়ে এক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক ভালোভাবে পার করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে জার্মানির অর্থনীতি প্রায় শূন্য দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গাড়ি নির্মাণ শিল্পে নির্গমনের মাত্রা নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়ায় উৎপাদন কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। বিশেষজ্ঞরা যদিও আশা করছেন, শেষ প্রান্তিকে অর্থনীতিতে একটি গতি আসবে। তবে বাইরের সমস্যা ঘরে চলে এলে সুসময় তাও থাকতে পারে। খ্যাপাটে মার্কিন প্রেসিডেন্টের রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে একটা শঙ্কা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইতালির বেয়াড়া সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ার কারণে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমাতে হয়েছে জার্মানিকে, যা মোটামুটি ১ দশমিক ৫০ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে রাজস্বসংকট তৈরির সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতখোলা মনোভাব কিছুটা সীমাবদ্ধ করে দেবে।
রাজনীতি নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা এগিয়ে আসছে সামনে। ডিসেম্বরে হামবুর্গে অনুষ্ঠেয় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলের সম্মেলনে দলীয় সভানেত্রীর পদ ছেড়ে দেবেন জার্মানের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। এর ফলে বর্তমান জোটের পতনসহ ব্যাপক রাজনৈতিক ভাঙন হতে পারে। নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যয় কমানো সহজ হবে না। গত অক্টোবরে হঠাৎ করেই দলীয় সভানেত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান জার্মানের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। তাঁর এই সিদ্ধান্ত জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। টানা ১৮ বছর দলীয় সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই জার্মান সরকারের আশঙ্কা, যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে অর্থনীতি। অনেক সময়ই সরকার তার প্রতিশ্রুতি সংযত করেছে।
জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা জ্যাটেলমেয়ার বলেন, জার্মানির সাফল্যের অন্যতম সমস্যা হলো এটি কাঠামোগত অযোগ্যতা মোকাবিলা করা থেকে সরকারকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
দ্য সেন্টার ফর ইউরোপীয় রিফর্মের ক্রিশ্চিয়ান ওডেনডাহল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানির অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণ হলো ‘ভাগ্য’। বিশ্বব্যাপী জার্মান পণ্যের চাহিদা, ইউরোর দর কমা ও স্বল্প সুদের হার জার্মানির সৌভাগ্য বয়ে এনেছে। কিন্তু এই সৌভাগ্যের সময়ে জার্মানি তার সুরক্ষিত সেবা খাতকে আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করার সুযোগ কাজে লাগায়নি। ডিজিটালাইজেশন ও কর সংস্কারকে উন্নত করতে পারেনি। কেবল রপ্তানি দিয়ে উন্নয়ন এনেছে দেশটি। আসলে ইউরোজোনের অন্য দেশগুলোর মতো কেবল চাপে পড়েই সংস্কার এনেছে জার্মানি। তাই পুরোপুরি অর্থনৈতিক শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না দেশটিকে।
এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়টি আসছে। ২০০৫ সাল থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে থাকা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো জনপ্রিয় কোনো নেতা বা নেত্রী এ মুহূর্তে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে নেই। সাবেক দলীয় পার্লামেন্ট–প্রধান ফ্রিডরিশ মের্স দলীয় প্রধানের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে ডিসেম্বরে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলের সম্মেলনেই আঙ্গেলা ম্যার্কেলের উত্তরসূরি নির্বাচিত হবে। সেদিকে তাকিয়ে আছে এখন পুরো দেশ।
No comments:
Post a Comment