মাছ চাষে আর সুখ নেই
*গতবার মৎস্য খাত থেকে আয় দেখান আ. লীগের প্রায় ২৮ প্রার্থী
*২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এনবিআর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে
*মাছ চাষের আয়ের ওপর ৩ শতাংশ উৎসে কর তুলে নেওয়া হয়
*সুবিধা তুলে দিলে মাছ চাষে রাজনীতিবিদদের আয় কমে যায়
মাছ চাষে এখন আর সুখ নেই। এ কথাটি অন্তত মৎস্যখামারি রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দশম সংসদ নির্বাচনে রাজনীতিবিদদের অনেকে মাছ চাষ থেকে বিপুল আয় দেখিয়েছিলেন। এবার তাঁদের অনেকেই মাছ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন! অনেকের আয় একেবারেই কমে গেছে।
মাছ চাষ থেকে রাজনীতিবিদদের আয় কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে কর–সুবিধা তুলে নেওয়ার পর। ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মাছ চাষের আয়ের ওপর ৩ শতাংশ উৎসে কর তুলে নিয়ে সাধারণ করহার কার্যকর করে। এই প্রজ্ঞাপনের কারণে কার্যত কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত মৎস্য খাতে দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় মৎস্য খাত থেকে আয় দেখিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুল উল আলম হানিফ, মাদারীপুর-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর-ই আলম চৌধুরী, ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্সহ আওয়ামী লীগের প্রায় ২৮ জন প্রার্থী। চিংড়ির ঘের ও শেয়ার ব্যবসা থেকে গতবার প্রায় ৯ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছিলেন নূর-ই আলম চৌধুরী। তাঁর এবারের হলফনামায় চিংড়ির ঘেরের কোনো তথ্য নেই, আয়ও নেই। মাছ চাষ থেকে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্র বছরে ৫ কোটি টাকা আয় ছিল। এবার তা কমে ৬৮ লাখে নেমেছে। ব্যবসা অথবা মাছ চাষ থেকে মাহবুল উল আলম হানিফের আয়ও কমেছে।
বিগত নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনের সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপসের হলফনামায় চা, রাবার অথবা মৎস্য খামার খাতে নিজের সম্পদ দেখানো হয়েছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকার। এবার সেই সম্পদ তালিকায় নেই। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের স্ত্রীরও চা, রাবার বাগান অথবা মৎস্য খামার শিরোনামে ৪১ লাখ টাকার সম্পদ ছিল, যা এবার দেখানো হয়নি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এখন মাছ চাষ করে আয় করলে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। ২০০৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত মৎস্য খাতের আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত ছিল। ওই বছর জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বার্ষিক দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখা হয়। এর বেশি আয় হলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ সরকারি বন্ড বা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এরপর ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৫ শতাংশ হারে করারোপ করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে এই করহার ৩ শতাংশে নামিয়ে দেওয়া হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এই সুযোগটিই অনেকে নেন। কারণ, একে তো করহার মাত্র ৩ শতাংশ, অন্যদিকে আয়কর কর্মকর্তাদের পক্ষে পানির নিচে মাছ গুনে দেখা সম্ভব নয়। আবার বিনিয়োগের পরিমাণও যাচাই করা কঠিন। ফলে মাছ চাষ হয়ে ওঠে কালোটাকা সাদা করার বড় ক্ষেত্র।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মৎস্য খাত যে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার একটি উপায় ছিল, সেটা প্রমাণিত হলো এবার। রাজনীতিবিদদের উচিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সেটা না করে তাদের অনেকে যেকোনো প্রকারে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার উপায় খোঁজেন।
হলফনামাগুলো নির্বাচন কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রার্থীরা যে সম্পদের হিসাব দিচ্ছেন সেটা যথার্থ কি না, তা খতিয়ে দেখার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আছে। তবে সেটা তারা কখনো দেখে না। বৈধ আয়ের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য আছে কি না, তা দুর্নীতি দমন কমিশনও খতিয়ে দেখতে পারে।
মৎস্য খামার নেই নূর-ই আলম চৌধুরীর
মাদারীপুর-১ আসন থেকে গতবারের মতো এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূর-ই আলম চৌধুরী। গতবার হলফনামায় তিনি চিংড়ির ঘের ও শেয়ার ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। একই খাতে তাঁর নির্ভরশীলদের আয় ছিল ৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এবার মৎস্য খাত থেকে কোনো আয় দেখাননি তিনি।
মৎস্য খামার নেই হানিফের
এবারের নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবারের হলফনামায় মাহবুব উল আলম হানিফ মোট বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯০০ টাকা, যা আগের বারের চেয়ে বেশ কম। গতবার হানিফ আয় দেখিয়েছিলেন ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭০ লাখই আসত মাছ চাষ থেকে।
এবার হানিফ ব্যবসা থেকে বছরে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। গতবার তিনি ব্যবসার ঘরে বন্ধনীতে মৎস্য উল্লেখ করেছিলেন। এবার তিনি শুধু ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মৎস্য খাত তাঁর আয়ের বড় উৎস। হলফনামায় সেটা থাকার কথা। পরে তিনি জানান, ব্যবসার আয়ই মাছ চাষের আয়।
মাহবুব উল আলম হানিফের নিজ নামে অথবা পরিবারের নামে কোনো কৃষিজমি নেই। চা, রাবার বাগান বা মৎস্য খামারের ঘর ফাঁকা রাখেন তিনি।
সরে গেছেন তাপস
বিগত নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনের সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপসের হলফনামায় চা, রাবার অথবা মৎস্য খামার খাতে নিজের সম্পদ দেখানো হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি ৯১ লাখ টাকার। স্ত্রীর নামে একই খাতে ছিল প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৭১ হাজার টাকার সম্পদ। এবার নিজ বা স্ত্রীর নামে এ খাতে কোনো সম্পদ দেখাননি শেখ ফজলে নূর তাপস। গতবার নিজের নামে ২ বিঘা সাড়ে ১০ কাঠা কৃষিজমি দেখিয়েছিলেন তিনি। এবার দেখিয়েছেন সাড়ে ১০ কাঠা। স্ত্রীর নামে গত বছর কোনো কৃষিজমি ছিল না, এবার ১১২ শতাংশ কৃষিজমি দেখিয়েছেন তিনি। দেখা যাচ্ছে, মাছের ব্যবসা থেকে সরে গেছেন তিনি।
ইলিয়াসের মাছের আয়ে ধস
ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্র বার্ষিক মোট আয় এখন ২ কোটি ৮ লাখ টাকার মতো, যা বিগত নির্বাচনের আগে ৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা ছিল। ফলে গত পাঁচ বছরে ইলিয়াস উদ্দিনের আয় কমে অর্ধেকের কমে নেমেছে। কমেছে মূলত মৎস্য খাতে আয়। ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ গতবার মাছ চাষ থেকে আয় দেখিয়েছিলেন বছরে ৫ কোটি টাকা। এবার দেখিয়েছেন ৬৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
শাহরিয়ার আলমের স্ত্রীর মৎস্য খামারটি নেই
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিগত নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় স্ত্রীর নামে চা–বাগান, রাবার বাগান, মৎস্য খামার শিরোনামের খাতে ৪০ লাখ ৭০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে বাড়ি অথবা অ্যাপার্টমেন্ট দেখিয়েছিলেন সাড়ে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের। এবার স্ত্রীর নামের চা–বাগান, রাবার বাগান অথবা মৎস্য খামার খাতে কোনো সম্পদ দেখানো হয়নি। তবে এবার স্ত্রীর নামে ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার অকৃষি জমি ও সাড়ে ১৫ লাখ টাকার অ্যাপার্টমেন্ট আছে বলে উল্লেখ করেছেন শাহরিয়ার আলম।
সাইমুম সরওয়ারের আয় বেড়েছে
সাইমুম সরওয়ার কমল কক্সবাজার-৩ আসন থেকে গতবারের মতো এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। গতবার তিনি মৎস্য খাত থেকে আয় দেখান ৬ লাখ টাকা। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, কক্সবাজারের রামু উপজেলায় তাঁর একটি মৎস্য খামার আছে। যেটি তিনি ইজারা দিয়েছেন। এবার তিনি মৎস্য খাত থেকে আয় দেখিয়েছেন বছরে ২৭ লাখ টাকা। যদিও স্থাবর সম্পদের তালিকায় মৎস্য খামার শ্রেণিতে তিনি কোনো সম্পদ দেখাননি। খামারটি স্ত্রীর নামেও দেখাননি তিনি।
এ ছাড়া ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করা স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মৎস্য খাত থেকে বছরে ২ কোটি ৪২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment